Home»   » মাইনাস মার্কিং: উচ্চশিক্ষায় অবনতি

মাইনাস মার্কিং: উচ্চশিক্ষায় অবনতি

মীর হালিম: একটি জাতির উন্নতির চাবিকাঠি হলো শিক্ষা । দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্য পূরণে শিক্ষাই হচ্ছে প্রধান অবলম্বন । মেধা ও মননে আধুনিক এবং চিন্তা চেতনায় অগ্রসর একটি সুশিক্ষিত জাতিই একটি দেশকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিতে পারে। তাই শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। এই মেরুদন্ডের রোগবালাই একজন মানুষকে যতটা দুর্বল করে দেয় একই ভাবে শিক্ষাব্যবস্থায় পচন ধরলে উন্নতির বদলে একটি জাতি অবনতির দিকে ধাবিত হয়। উচ্চশিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলো মৌলিক জ্ঞান বিজ্ঞান সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের গবেষণায় উৎসাহী করা, উদ্ভাবনী শক্তি বাড়ানো এবং দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা।

আমাদের জাতীয় শিক্ষানীতি, ড. কুদরাত এ খুদা কমিশন থেকে শুরু করে সর্বশেষ ২০১০ সংস্করণ, আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষা প্রদানের কথা বলে। একাডেমিক লাইফে পরীক্ষার মাধ্যমে সক্ষমতা যাচাই করে একটি স্বীকৃত শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন করাই একজন শিক্ষার্থীর প্রাথমিক লক্ষ্য। শিক্ষাব্যবস্থায় প্রচলিত শিক্ষার মূল্যায়ন পদ্ধতি, পরীক্ষা পদ্ধতি বা শিক্ষার্থীর শিক্ষার মান যাচাই পদ্ধতি উন্নত এবং অনুন্নত দেশে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। আমাদের দেশে একাডেমিক অঙ্গনে অপ্রচলিত একটি বিষয় মাইনাস মার্কিং কে কেন্দ্র করে সম্প্রতি বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এ ঘটনাকে উচ্চশিক্ষায় মান অবনতি কিংবা স্বেচ্ছাচারিতা বলা যেতে পারে।

গত ২৭ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের একজন অধ্যাপক ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ক্রিমিনোলজি কোর্সের দুইটি টার্ম পরীক্ষা ও টিউটোরিয়ালে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের নাম্বারে ‘মাইনাস মার্কিং’ (Minus/Negative Marking) দিয়েছেন মর্মে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে যা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম বহির্ভূত এবং ছাত্রদের ওপর অন্যায়। শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইন পেজে প্রকাশিত এই নাম্বারপত্রে মাইনাস মার্কিং লক্ষ্য করে এবং ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দ্রুত জানাজানি হলে তাৎক্ষণিকভাবে মার্কশিট অনলাইন থেকে মুছে দেওয়া হয় যা নিয়ে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। আত্মপক্ষ সমর্থনে ওই শিক্ষক এটিকে অনানুষ্ঠানিক মার্কশিট বলেছেন যা আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মের ভিত্তিতেই প্রকাশ করা হবে‌ বলে অভিযোগ খন্ডন করার চেষ্টা করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় নিয়মে এ ধরণের টার্ম/টিউটোরিয়ালের বেলায় আনুষ্ঠানিক মার্কশিট কিংবা মাইনাস মার্কিং বলে কিছু নেই। তাছাড়া এটাও পরিষ্কার নয় যে এই মাইনাস মার্কিং এর চূড়ান্ত পরিণতি কি হবে? একজন শিক্ষার্থীর প্রাপ্ত মোট নাম্বার থেকে এটা মাইনাস হবে? অতি আগ্রহী কিছু সৃজনশীল চিন্তাভাবনা আইন দ্বারা সীমাবদ্ধ । তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক নিয়মবহির্ভূত এ ধরনের চর্চা বেআইনি হিসেবেই বিবেচিত হবে।

একজন শিক্ষার্থী যাচিত প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে না পারলে শূন্য পাবে। সারাদেশের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীরা কন্ডিশনাল ও সর্বোচ্চ মার্ক পেয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হয়। ক্রিমিনোলজি মৌলিক বিজ্ঞানের মত এমন কোন কঠিন সাবজেক্ট নয় যে এতে ছাত্ররা এভাবে ফেল করবে কিংবা মাইনাস মার্কিং পাবে। অত্যন্ত মেধাবী এসব শিক্ষার্থীরা যদি ফেলই করবে এই দায়ভার কোর্স শিক্ষক হিসেবে ওনার উপরে কি বর্তায় না?

যেসব সবুজ অবুঝ কিংবা নিবুঝ শিক্ষার্থীরা এই অন্যায় আচরণের শিকার হলো বা ভিকটিম হল, তারা সুবিচার পাবে কি? ন্যায় বিচার সম্পর্কে তাদের ধারণার কি উন্নতি হবে? তারা কি গাধা গর্দভ এসব উপাধি নিয়েই বেঁচে থাকবে? নাকি বিচারের বাণী নিভৃতে কান্নাকাটি করেই যাবে! এই কচিকাঁচা বাচ্চারা যদি ওনার পদত্যাগ, ডিমোশন কিংবা কোর্স থেকে প্রত্যাহারের দাবি তোলে এটা কি খুব অন্যায় হবে? তাই একাডেমিক টার্ম ও টিউটোরিয়াল পরীক্ষায় মাইনাস মার্কিং এর নিয়ম বহির্ভূত ব্যবহার বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী রাখে।

বাংলাদেশে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা ব্যবস্থায় মাইনাস মার্কিং পদ্ধতির কিছুটা প্রচলন থাকলেও শিক্ষাব্যবস্থায় বা একাডেমিক শিক্ষণে বা মূল্যায়নে এর প্রচলন নেই বললেই চলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় নেগেটিভ মার্কিং এর প্রচলন রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির ক্ষেত্রে,
ডি ইউনিটের নিয়ম অনুসারে প্রতি ভুল উত্তরের জন্য.২৫ করে নেগেটিভ মার্ক কাটা হয়ে থাকে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রেও একই ধরনের নিয়ম শুরু হয়েছে। বিসিএস চাকুরী প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় মাইনাস মার্কিং এর বন্যায় ভেসে ভেসে অনেকেই পিএসসি থেকে হারিয়ে যায়। নিয়ম অনুসারে প্রতি ভুল উত্তরের জন্য ০.৫ করে নেগেটিভ মার্ক কাটা হয়। ভারতীয় সরকারী চাকুরী প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় এ ধরনের নেগেটিভ মার্কিং এর ব্যবহার রয়েছে।

এবার দেখা যাক সারা বিশ্বব্যাপী শিক্ষার্থীদের কে আন্তর্জাতিক মানদন্ডে যাচাই করার জন্য কয়েকটি পদ্ধতির মধ্যে নেগেটিভ মার্কিং এর ব্যবহার নাই। SAT/এসএটি একটি আমেরিকান পদ্ধতি যার মাধ্যমে আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতে সারা বিশ্ব থেকে শিক্ষার্থী ভর্তি করার জন্য বাছাই করা হয়। এর পরীক্ষাতে নেগেটিভ মার্কিং নেই। ২০২২ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১ কোটি ৭০ লক্ষ শিক্ষার্থী এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার মাধ্যমে আমেরিকান কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতে ভর্তির জন্য যোগ্য বিবেচিত হয়েছে। GRE নামক পরীক্ষার মাধ্যমে ও আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতে সারা বিশ্ব থেকে শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য বিবেচনা করা হয় সেখানেও নেগেটিভ মার্কিং নেই।

যুক্তরাজ্যের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির জন্য আইইএলটিএস নামক যে মানদণ্ডের পরীক্ষা রয়েছে সেখানেও নেগেটিভ মার্কিং নেই। সর্বশেষ ২০১৮ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সারা বিশ্ব থেকে ৩ কোটি ৫০ লক্ষ শিক্ষার্থী এই পরীক্ষার মাধ্যমে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য বিবেচিত হয়েছে।

আমাদের দেশে নিকট অতীতে কম নম্বর পাওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য গ্রেস নাম্বার বলে একটি নিয়ম প্রচলিত ছিল, যেখানে নূন্যতম পাস নাম্বার ছিল ৩৩ । কেউ যদি ৩২ পেতো তাকে ১ নাম্বার গ্রেস দিয়ে অথবা ৩১ পেলে ২ নাম্বার গ্রেস দিয়ে কিংবা ৩০ পেলে ৩ নাম্বার গ্রেস দিয়ে তাকে পাস করানোর ব্যবস্থা করা হতো। একজন শিক্ষার্থীর ঝরে যাওয়া কিংবা গন্তব্যহীন হওয়া থেকে বাঁচানোর জন্য কিংবা শিক্ষার হার বাড়ানোর জন্য এ নিয়ম প্রচলিত ছিল বলে ধারণা করা হয়।

সংবিধান অনুযায়ী আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা ও দায়িত্বশীল নাগরিক সৃষ্টির জন্য আইন শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। জনগণের আইনগত অধিকার সংরক্ষণ ও আইনের শাসন নিশ্চিত করতে সুদক্ষ শিক্ষক, আইনজীবী, আইনবিদ ও বিচারক তৈরিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের অবদান ঐতিহাসিক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগ ন্যায়বিচারের ধারণা শিক্ষণ, প্রশিক্ষণ কিংবা প্রকাশের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করুক এই প্রত্যাশাই করি।

আইনজীবী ও পাবলিক পলিসি এনালিস্ট

জাগো লাইভ/নাসি