জাগো লাইভ২৪.কম | আপডেট: 1:07 AM, April 3, 2018
Home» » নারীর একা বসবাস?
নারীর একা বসবাস?
জাগো লাইভ ২৪.কম
মেয়েটা একা থাকে। এই একটি বাক্যই সমাজের নানান খাঁজে অবিশ্বাস্য কম্পন সৃষ্টি করে। সেই ‘অরক্ষণীয়া’ ‘হতভাগা’ নারীর জন্যে দুশ্চিন্তায় সমাজের কোঁচকানো কপাল আরও কুঁচকে যায়। একটি একা মেয়ে কীভাবে সমাজের চিরায়ত বিশ্বাসের ভিত্তিপ্রস্তর ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় সেই গল্প শুনছিলাম ফৌজিয়া সুলতানার সাথে। ফৌজিয়া একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। ঢাকা শহরে একা থাকেন। পরিবার, আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী, প্রাক্তন সহপাঠী, সহকর্মী- সবার একটাই চিন্তা কখন ফৌজিয়া বিয়ে করবেন!
কেন তারা ফৌজিয়ার একা থাকার বিষয়টিকে সহজভাবে নিতে পারছেন না? ফৌজিয়া কি তাদের সবাইকে বলে বেড়িয়েছেন যে তিনি আর একা থাকতে পারছেন না, একা থাকতে তার খুব কষ্ট হয় কিংবা তার একজন স্থায়ী সঙ্গী দরকার?
তা কিন্তু নয়। এই শুভাকাঙ্খীর দল স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, ফৌজিয়ার একা থাকা ঠিক নয়। কেন তারা মনে করছেন একা থাকা ঠিক নয়?
ফৌজিয়ার মতে, পরিবার ও নিকটাত্মীয়দের ভয়টা হল, তাদের পরিবারের মেয়েটি হয়তো একা থাকতে গিয়ে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়বে। আত্মীয়স্বজনেরাও তার মত একা বসবাস করা মেয়ের দিকে সন্দেহের চোখেই তাকায়। কিন্তু দেখা যায় তার বয়সী অনেক ছেলেই একা থাকে, কাজের সূত্রে দেশের নানান প্রান্তে তারা একা বসত গড়েছে, কিন্তু ছেলেদের একা থাকা নিয়ে সমাজ বা তাদের আত্মীয়দের তেমন কোন মাথাব্যথা দেখা যায়না। ছেলেদের তথাকথিত নৈতিকতা রক্ষা বা সম্পর্কের নৈতিকতা নিয়ে তাদের নিকটজনেরাও তেমন চিন্তিত নয়। এটি সমাজের আরেক দ্বিমুখী আচরণ বলে মনে করেন ফৌজিয়া। আর পরিবারের লোকজন মনে করেন একা থাকার কারণে তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। যদিও তিনি নিজে তেমন কোন সমস্যা বোধ করেন না। তবুও পরিবারের লোকেরা অনবরত মনে করিয়ে দিতে থাকেন যে তিনি নিরাপত্তাহীন একটা জীবন যাপন করছেন। পাড়া প্রতিবেশীরা মনে করেন একা থাকার সিদ্ধান্ত নেয়ার মত বেপরোয়া কাজ করছে যে মেয়েটি, সে আসলে ‘বেয়াদব।’ তার জীবন যাপনে কোন বাঁধা ধরা নিয়ম নেই, কোন বাঁধন নেই।
ফৌজিয়া আরো জানান, মধ্যবিত্ত এলাকাগুলোতে একা মেয়েকে কোন বাড়িওয়ালা ভাড়া দিতে চাননা। সুতরাং বাধ্য হয়েই তাকে মেস করে থাকতে হয় অন্য আরো মেয়ের সাথে। সেখানেও অনেক বাড়িওয়ালারা সুযোগ নেন। দেখা যায় একটা পরিবারকে ভাড়া দিলে যেখানে ভাড়া অনেক কম নিতেন সেখানে এই মেয়েদের কাছ থেকে তারা দ্বিগুণ ভাড়া আদায় করেন। আবার কর্মক্ষেত্রে দেখা যায় আরেক বিড়ম্বনা। যতক্ষন পর্যন্ত কর্মক্ষেত্রের লোকজন জানেনা যে তিনি একা থাকেন ততক্ষণ পর্যন্ত তারা সম্মানের সাথে বুঝে শুনে তার সাথে কথা বলেন। কিন্তু যেই তারা কোন উপায়ে জানতে পারেন যে তিনি একা, তখনই তার প্রতি তাদের আচরণে স্পষ্ট পরিবর্তন লক্ষ্য করেন ফৌজিয়া। তার মতে, একটা মেয়ে একা থাকতে পারবেনা, মেয়েরা সবসময়ই অন্য কারও উপর নির্ভরশীল থাকতে পছন্দ করে এই বিষয়টা আসলে ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের মাথায় গেঁথে দেয়া হয় পরিবার থেকেই। মেয়েদেরকে মূলত আত্মনির্ভরশীল হতেই দেয়া হয়না এসব বলে বলে।
ফৌজিয়া বলেন, এই যে আমি সারাদিন অফিসে খেটেখুটে আবার বাসায় ফেরার পথে বাজার করি। বাসায় গিয়ে রান্না করি, খাই। কখনো অসুস্থ থাকলে এক গ্লাস পানিও এগিয়ে দেয়ার কেউ থাকেনা। এর মাধ্যমে আমি কিন্তু আত্মনির্ভরশীল হচ্ছি। আমার এই পরিশ্রমগুলো নিয়ে কিন্তু কাউকে কখনো চিন্তিত হতে দেখিনি। সবার ধারণা একা একা আমি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, খুব আনন্দ করছি সারাক্ষণ! পরিবারের মানুষদের মানসিকতা পাল্টালেই একসময় সমাজও পালটে যাবে বলে মনে করেন ফৌজিয়া। কারণ, আমাদের প্রাথমিক বাঁধা বা ধাক্কাটা আসে পরিবার থেকেই। বাইরের লোকেদের কথা পাত্তা না দিয়েও থাকা যায়, কিন্তু নিজের আপনজনদের কথা অনেকসময় আমাদেরকে দুর্বল করে তোলে।
একা নারীকে বাড়ি ভাড়া দিবেন কি না এই প্রশ্নের জবাবে ঢাকা শহরের এক বাড়িওয়ালা সোহেল ইসলাম (ছদ্মনাম) বলেন, না, দেবনা। একা নারীকে বাড়ি ভাড়া না দেবার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এর সাথে পুরোপুরিই সামাজিক কারন জড়িত। আমি একটা কমিউনিটিতে থাকি, পরিবার নিয়ে থাকি, স্বাভাবিকভাবেই আমি চাইবো না সবার প্রশ্নের মুখে পড়তে। ব্যাপারটা শুধু একা নারীর ক্ষেত্রে না, একা পুরুষকেও তিনি বাড়ি ভাড়া দেননা বলে জানালেন। তার মতে, একা নারী বা পুরুষ অনৈতিক বা অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়তে পারে, এই ভয়টাই সবচেয়ে বেশি কাজ করে। এছাড়াও তার ধারণা, পরিবারের মধ্যে যারা থাকে তারা সুস্থ জীবনযাপন করে। একা নারী বা পুরুষ হয়তো ড্রাগেও আসক্ত হতে পারে বলে তিনি মনে করেন। তিনি আরো বলেন, একাকী নারীদেরকে ভাড়া দেয়ার ব্যাপারটা মানবিক। কিন্তু যখন আমরা সমাজে এবং পরিবারে থাকি তখন মানবিক দিক ছাপিয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে সমাজের গ্রহণযোগ্যতা।
কথা হচ্ছিল স্কুলশিক্ষক জুয়েনা আহমেদের সাথে। জুয়েনা একজন একা মা, ছয় বছরের শিশু সন্তানকে নিয়ে থাকেন। তার আশেপাশের সবার কাছ থেকে এখন সবচেয়ে বেশি যে প্রশ্নটা শুনতে পান সেটি হল, ‘বিয়ে কখন করবা?’
জুয়েনা একা বেশ ভালো আছেন। তবুও মাঝে মাঝে মনে হয় তার একজন সঙ্গী থাকলে অন্তত জীবনের কিছু যুদ্ধ একসাথে করা যেত। কিন্তু সঙ্গী নির্বাচন করতে হলে তো আগে মানুষটার সাথে পরিচিত হতে হবে, কথা বলে জানতে হবে মানুষটাকে। এক্ষেত্রে জুয়েনা লক্ষ্য করেন তার সমাজের লোকেরা অদ্ভুত এক বিপরীত আচরণ করছেন। একদিকে তো তারা জুয়েনার বিয়ের জন্য দারুন চিন্তিত। অন্যদিকে বিয়ে করার জন্যে যে জুয়েনা সঙ্গী নির্বাচন করবেন, আর সেই উদ্দেশ্যে যে তিনি কারো সাথে সময় কাটাবেন সেই সময়টুকু দিতেও সমাজের লোকের ভীষণ আপত্তি।
আশেপাশের মানুষের এই বিচিত্র দ্বিমুখীতার কোন তল খুঁজে পাননা জুয়েনা। এছাড়াও তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে সবার প্রচন্ড আগ্রহ টের পান জুয়েনা। তার ছোট্ট ছেলেকেই অনেকে ধরে ধরে জিজ্ঞেস করেন, তার বাবা তাকে দেখেতে আসে কি না! জুয়েনা বলেন, এতে যে শিশুটির মনে প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি হয় এই বোধটা অনেকেরই নেই।
জুয়েনা আরো জানান, যখন প্রথম তিনি সেপারেশনে যান সেই সময় একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে কাজের কথা অনেকদূর এগিয়ে যায়। সবকিছু বেশ সুন্দরভাবে এগোচ্ছিলো। সবশেষে তারা জুয়েনাকে তার বৈবাহিক অবস্থা এবং পারিবারিক ডিটেইলস জানাতে বলে। তিনি যখনই জানান তিনি সেপারেশনে আছেন, এর পরে আর সেই কাজটি তার হয়নি। একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি থেকে এমন আচরণ পেয়ে তিনি প্রচন্ড অবাক হয়েছিলেন। সবচেয়ে বেশি যেটা জুয়েনাকে পীড়া দেয় তা হল, তিনি একটি সংসার ছেড়ে এসেছেন এটা জানার পরে সব বয়সের, বিবাহিত-অবিবাহিত, তরুণ-মধ্যবয়স্ক এমনকি বৃদ্ধ পুরুষেরাও তাকে সহজলভ্য মনে করে। তারা মনে করে যে কেউ চাইলেই তিনি তাদের ডাকে সাড়া দিতে সদাপ্রস্তুত থাকবেন। সমাজের লোকেদের এই মানসিকতা জুয়েনাকে প্রচণ্ড আহত করে। মানসিকভাবে তাকে দুর্বল করে তোলে এইসব নেতিবাচক আচরণ।
ফৌজিয়া আর জুয়েনার অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, সমাজেরই একটি অংশ একা নারীকে সহজলভ্য মনে করছে। আবার সেই সমাজই একা নারীর নৈতিক অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। নারী একা থাকতে নিজে কোন সমস্যা বোধ না করলেও সমাজ নারীর একা থাকাটাকে একটা বিশেষ সমস্যা বলে মনে করে। সমাজের বেঁধে দেয়া নৈতিকতার সংজ্ঞার সাথে নারীর একা থাকাটাকে তারা বিরোধপূর্ণ মনে করে। একজন একা নারী সারাদিনে নানান কাজ করলেও সবার মাথায় একা নারী দেখলেই মনে হয় সে সারাদিন সে অনৈতিক সম্পর্ক করে বেড়াচ্ছে। আর তাই অপেক্ষাকৃত বেশি বয়সের নারীদের একা থাকা নিয়ে সেভাবে কেউ মাথা ঘামায় না। সব মিলিয়ে নারীর একা থাকাকে সমাজের লোকেরা বলতে গেলে অসম্ভব করে তোলে এবং সবশেষে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে মেয়েরা একা থাকতে পারেনা।
নারীদের একা থাকার সক্ষমতা নিয়ে এদেশের সমাজ নানা প্রশ্ন তুললেও গবেষণা কিন্তু বলছে ভিন্ন কথা। ২০১৭ সালে কনজিউমার অ্যানালিস্ট মিন্টেলের একটি গবেষণায় বেরিয়ে আসে ব্রিটিশ নারীদের মধ্যে ৬১ শতাংশ তাদের একাকী জীবনে বেশ আনন্দে আছেন যেখানে পুরুষদের মধ্যে এই হারটি ৪৯ শতাংশ। এতে আরও দেখা যায় ৭৫ শতাংশ একা নারীই নতুন কোন সম্পর্কে জড়াতে আগ্রহ বোধ করছেনা, পুরুষদের মধ্যে ৬৫ শতাংশের মধ্যে এই প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক বেলা পাউলোতো মনে করেন, একা থাকার অনেক উপকারিতা রয়েছে। তার মতে, বিশেষত নারীরা পুরুষদের চেয়ে বেশি একাকী জীবনটাকে উপভোগ করে। কারণ একা নারী নিজের প্যাশনের পেছনে যথেষ্ট সময় দিতে পারে। তারা নিজেদের পুরোটা সামর্থ্য অর্থপূর্ণ কাজে ব্যয় করতে পারে, নিজেদের পছন্দের একটা জীবন কাটাতে পারে এবং সামাজিক কাজে বেশি সক্রিয় থাকে যা তার জীবনটাকে আনন্দময় করে তোলে।
অর্থাৎ প্রকৃতিগতভাবে পরিবার ছাড়া থাকতে নারীদের তেমন সমস্যা না থাকলেও একা মেয়েদের উপর বিয়ে করার জন্যে সমাজের একটা অস্বাভাবিক চাপ থাকে। কেন সমাজ একা নারীদের সহজে গ্রহণ করতে পারেনা এই প্রশ্ন রাখা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ডঃ হুমায়ূন কবিরের কাছে। ডঃ হুমায়ূন বলেন, এই পুরো ভাবনাটিই সমাজভেদে এবং ব্যাক্তির আর্থ-সামাজিক অবস্থানভেদে পরিবর্তিত হয়। যেমন পাশ্চাত্য সমাজ যথেষ্ট পিতৃতান্ত্রিক হবার পরেও অনেক দীর্ঘ একটা অর্থনৈতিক, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক পথ পরিক্রমার কারণে সেই সমাজ মানুষের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে খুব একটা চিন্তিত হয়না। অন্যদিকে আমাদের সমাজে পিতৃতান্ত্রিকতার সাথে সাথে ধর্মীয় অনুশাসন, সুশিক্ষার অভাব, আর্থ-সামাজিক অবস্থান, যুগ যুগ ধরে চলে আসা সামজিক মুল্যবোধসহ নানান অনুঘটক কাজ করে মানুষের মনন তৈরিতে। তিনি আরও বলেন, আমাদের সমাজেও দেখা যায় আর্থিক অবস্থা যদি বেশ ভালো হয় কিংবা কেউ যদি কোন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা হন তাহলে তার ব্যাক্তিগত জীবনাচরণ নিয়ে খুব কম মানুষই কথা বলার সাহস করে। অর্থাৎ সমাজের বেঁধে দেয়া নৈতিকতা ও মূল্যবোধের ধারণা ব্যাক্তির আর্থ-সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী পালটে যায়।
তিনি আরো বলেন, সমাজ কর্তৃক বেঁধে দেয়া নৈতিকতা আর মূল্যবোধের আসলে কোন সুস্পষ্ট সংজ্ঞা নেই। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণিতে এই নৈতিকতার রূপ পরিবর্তিত হতে দেখা যায়। তাই পরিবারের ইতিবাচক ভূমিকার পাশাপাশি একটি দীর্ঘ সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক বিপ্লবই পারে একা নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিকে সহজ করে তুলতে।
জাগো লাইফ২৪.কম/ সূত্র সা/বা